পাকুন্দিয়ার নারীদের তৈরী পরচুলা যাচ্ছে আমেরিকায়

0

আছাদুজ্জামান খন্দকারঃ
নারী-পুরুষ সবাই চুল কাটেন। কেউ প্রয়োজনে আবার কেউবা ফ্যাশন করতে। সেলুনে কিংবা পার্লারে গিয়ে তারা চুল কেটে থাকেন। আবার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ নারীরা মাথার চুল আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেন। সেই ফেলে দেওয়া চুল এখন আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার শতাধিক নারী সেই চুল দিয়ে ‘পরচুলা’ বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরি করে দিন দিন স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। বাদ যায়নি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও। ওই নারীদের নিপুণ হাতের তৈরি এসব হেয়ার ক্যাপ বা পরচুলা এখন দেশের গন্ডী পেরিয়ে আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

এলাকাবাসি জানান, উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোড়ল বাড়িতে গত বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে জাহেদুল ইসলাম নামের এক ব্যাক্তি তাঁর নিজ বাড়িতে পরচুলা তৈরির কারখানাটি গড়ে তোলেন। সেখানে গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীসহ শতাধীক দরিদ্র নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পরচুলা তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন তিনি। এসব পরচুলা তৈরি করে প্রতিমাসে ৫-১০ হাজার টাকা আয় করছেন নারীরা। আর তাদের হাতের কারিশমায় তৈরি পরচুলা এখন যাচ্ছে আমেরিকার বাজারে।

সরেজমিনে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি টিন শেড ঘরে কাঠের টেবিলে মুখোমুখি হয়ে স্থানীয় শতাধিক নারী গভীর মনোযোগ দিয়ে পরচুলা বা হেয়ার ক্যাপ তৈরির কাজ করছেন। তাদের মধ্যে পূর্ণিমা, নাসিমা, মুসলিমা. সুমাইয়া ও তাহমিনাসহ বেশিরভাগ নারীই স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্রী। প্রতিটি টেবিলে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো আছে লাল রঙের প্লাস্টিকের ড্যামি মাথা। ড্যামি মাথার উপর রয়েছে নেট। নেটের ফাঁকে ফাঁকে সুচের ফোঁড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে আটকানো হচ্ছে একেকটি চুল। ড্যামির পুরো মাথায় সুক্ষভাবে চুল আটকিয়ে তৈরি করছেন একেকটি পরচুলা বা হেয়ার ক্যাপ। প্রতিটি টেবিলে মুখোমুখি হয়ে চারজন নারী কাজ করছেন।

কারখানার প্রশিক্ষক মমতা বেগম জানান, এই কারখানা এলাকায় গড়ে তোলায় শিক্ষিত বেকার নারীরা বাড়তি আয় করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এই কারখানায় মোট ১২০ জন নারী কাজ করছেন। তবে স্কুল-কলেজ খোলা হওয়ায় কিছু ছাত্রী চলে গেছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পরচুলা তৈরি করে ছাত্রীরাও আয়ের একটি সুযোগ পেয়েছে। একজন দক্ষ নারী শ্রমিক দুইদিনে একটি করে পরচুলা তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি পরচুলার মজুরি(আকার অনুযায়ী) ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন বিউটি পার্লার ও হকারদের কাজ থেকে সংগ্রহ করেন নারীদের চুল। এই চুল দিয়ে তারা তৈরি করছেন হেয়ার ক্যাপ বা পরচুলা।

পরচুলা কারখানায় কাজ করেন স্থানীয় একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী পূর্ণিমা ও নাসিমা। তারা জানান, এ কাজ করে তারা মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আয় করে থাকেন। তবে করোনার মধ্যে কলেজ বন্ধ থাকায় কাজ বেশি হতো এবং আয়ও বেশি হতো। এখন কলেজ খোলা থাকায় পড়াশোনার ফাঁকে ফাকেঁ কাজ করছেন তারা। এতে আগের তুলনায় আয় কম হচ্ছে। তবে এ কাজ করে তারা পড়াশোনার খরচ চালিয়েও পিতা-মাতাকে সহযোগীতা করে থাকেন।

গৃহবধু রিমা আক্তার জানান, তিনি শুরু থেকেই এ কারখানায় কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে ১২-১৩ হাজার টাকা আয় করছেন। সংসারের খরচ চালিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা সঞ্চয়ও করছেন তিনি। তিনি বলেন, এই কারখানাটি এ গ্রামে আসায় আমাদের মতো হত দরিদ্র পরিবারের নারীদের আয়ের একটি সুযোগ হয়েছে।

তারাকান্দি গ্রামের হেয়ার ক্যাপ তৈরীর কারখানার মালিক মোঃ হাদীউল ইসলাম বলেন, পরচুলা তৈরীর এসব সরঞ্জাম তিনি ঢাকা থেকে কিনে আনেন। পরচুলা তৈরি করে আবার ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে আমেরিকায় রপ্তানি করা হয়। সরকার যদি আমাদের আর্থিক সহায়তা ও সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা দিত তাহলে কাজের আরো প্রসার ঘটানো যেতো। এতে গ্রামের আরো অনেক হত দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। বর্তমানে এ গ্রামের ১২০ জন হত দরিদ্র নারী এ কাজে যোগ দিয়ে ঘুচিয়েছেন পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশা।

পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোজলিন শহীদ চৌধুরী বলেন, এলাকার দরিদ্র নারীরা পরচুলা তৈরির কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এটা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ কাজে তাদের কিভাবে সহযোগীতা করা যায় তা খতিয়ে দেখে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Share.