আছাদুজ্জামান খন্দকারঃ
সভ্যতার ক্রমবিবর্তন আর আধুনিক প্রযুক্তির ফলে দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এসেছে পরিবর্তন। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের জীবন যাত্রাকে সহজ করতে তৈরি হচ্ছে নানা রকম আধুনিক প্রযুক্তি। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন দেশের প্রতিটা অঞ্চলে। বদলে গেছে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষেরও জীবন যাত্রার মান। পাল্টে গেছে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ রান্নাঘরের চিত্রও। সেসব ঘরে এখন রান্নার কাজে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির জালানি বিদ্যুৎ ও এলপি গ্যাস। এই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও দাপটের মাঝেও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় এখনো সমানতালে টিকে আছে আবহমান গ্রাম বাংলার সেই চিরচেনা রান্নার জালানি উপকরণ গোবরের তৈরি শলার লাকড়ি বা মুঠে। আর্থিক সংকটের কারণেই তারা এখনো এ জালানি উপকরণ ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন সেই গোবরের তৈরি লাকড়ির কারিগররা।
এলাকাবাসি জানায়, প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষেরা বন-জঙ্গল থেকে লতা-পাতা ও ডাল-পালা কুড়িয়ে এনে জালানি হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহার করতেন। কালের বিবর্তনে এসব বন-জক্সগল কেটে সেখানে তৈরি করা হয়েছে আবাদি জমি ও বাসাবাড়ি। অপরদিকে নিত্যপণ্যসহ কাঠ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা পড়েছে মহাবিপাকে। ফলে জালানি উপকরণসহ অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন তারা। তাই নিম্ন আয়ের মানুষেরা এখনো গোবরের তৈরি লাকড়ি বা মুঠে ব্যবহার করছেন।
গোবরের লাকড়ি প্রস্তুতকারি কয়েকজন নারী জানান, এ লাকড়ি বা মুঠে তৈরির উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন গরু বা মহিষের কাঁচাগোবর, দুই থেকে তিন ফুট লম্বা বাঁশের কাঠি বা পাটখড়ি, ধানের তুষ বা কুড়া, প্রয়োজনে কিছু পানি। গোবর ও তুষ একত্রে মিশিয়ে ভালোভাবে চটকে পাটখড়ি বা কাঠির গায়ে মুষ্ঠি মুষ্ঠি করে এঁটে রোদে শুকাতে হয়। শুকানোর পর তা রান্নার জালানির জন্য উপযুক্ত হয়।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গোবরের লাকড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী ও শিশুরা। কেউ বাড়ির ওঠানে, কেউবা বাড়ির পাশে খোলা জায়গায় বসে তৈরি করছেন রান্নার এই জালানি। এ সময় দেখা গেছে, নারী ও শিশুরা কাঁচা গোবর ও তুষ একসঙ্গে মিশিয়ে ভালোভাবে চটকে দুই-তিন ফুট লম্বা পাটখড়ির গায়ে মুষ্ঠি মুষ্ঠি করে এঁটে দিচ্ছেন। পরে এগুলো বাড়ির পাশের পতিত জমিতে বাঁশের আড়া বেঁধে সেখানে দাঁড় করিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। তারা জানান, তিন থেকে চারদিন এভাবে থাকলেই লাকড়িগুলো শুকিয়ে যাবে। প্রতিদিনের তৈরি লাকড়িগুলো এভাবে শুকিয়ে ঘরে মজুদ করে রাখা হয়। এ লাকড়ি দিয়ে চলে সারাবছরের রান্নার কাজ। অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এ লাকড়ি তৈরি করা হয়।
শলার লাকড়ি প্রস্তুতকারী উপজেলার মধ্য পাকুন্দিয়া গ্রামের মনোয়ারা খাতুন ও জরিনা খাতুনসহ কয়েকজন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। গ্যাসের সিলিন্ডার ও কাঠের লাকড়ি কিনতে অনেক টাকার প্রয়োজন। আমরা এত টাকা পাব কোথায়। তাই আমরা নিজেদের পালিত গরুর গোবর দিয়ে শলার লাকড়ি তৈরি করে সারাবছর রান্নার কাজে ব্যবহার করি। এতে আমাদের কোনো টাকা পয়সা খরচ হয়না।
উপজেলার উত্তরপাড়া গ্রামের কৃষক রহমত আলি বলেন, দফায় দফায় নিত্যপন্নসহ কাঠের লাকড়ি ও গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম বিপাকে আছে। তাছাড়া বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় তারা লাকড়ির সংকটে পড়েছে। তাই নিম্ন আয়ের মানুষজন বিকল্প জালানি হিসেবে এখনো গোবরের লাকড়ির ওপর নির্ভরশীল।
এ ব্যাপারে পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর ই আলম বলেন, রান্নার সময় যখন গোবেরর মুঠে বা ঘুঁটে জালানো হয়, তখন এর থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হয়। এই ধোঁয়া চোখসহ শ্বাস-প্রশ্বাস ও লান্সের জন্য ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়া হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। কারণ এ ধোঁয়াতে রয়েছে ক্ষতিকারক মিথেন গ্যাস। এছাড়াও গোবর পুড়ে একপ্রকার চিকন ছাইয়ের সৃষ্টি হয়। ওই ছাই উড়ে গিয়ে খাদ্য দ্রব্যে পড়ে। এতে নানা ধরণের পেটের অসুখ-বিসুখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, গোবর একটি উৎকৃষ্ট জৈব সার। এটি চুলায় ব্যবহার না করে জমিতে ব্যবহার করাই উত্তম।