নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
পানির ওপরে লম্বালম্বি দুটি বাঁশ এবং জাল ফেলে তার ওপর কচুরিপানার স্তূপ দিয়ে তৈরী করা হয় ভাসমান বেড। কচুরিপানা পচে শুকিয়ে যাওয়ার পর সামান্য মাটি ছিটিয়ে দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি ও মসলা উৎপাদন করে খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কিশোরগঞ্জের কৃষকরা। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় এই চাষে ঝুঁকছেন জেলার অনেক কৃষক। আর কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ পৌর শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পুকুর, খাল, বিলে কচুরিপানা পচিয়ে ভাসমান বেড তৈরী করে চাষ করা হয়েছে লাল শাক, পালং শাক, লাউ, মিষ্টি কুমরা, টমেটো, পেঁয়াজ, বেগুন, বাঁধা কপি, মরিচসহ বিভিন্ন জাতের মসলা। কম খরচ আর লাভ বেশি হওয়ায় ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই জেলার কৃষকদের কাছে। বারি জাতের এসব সবজি ও মসলা স্থানীয় লোকজনের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন কৃষকরা।
জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সাতারপুর গ্রামের কৃষক খলিলুর রহমান বলেন, গত তিন বছর যাবত ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা আবাদ করছেন তিনি। বর্তমানে ১৬টি বেডে পাট শাক, মূলা শাক, ঢেরস, কপি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পুই শাক, টমেটো চাষ করছেন। এই গুলো চাষে যে খরচ হয়েছে খরচের তুলনায় বিক্রি করে তার চেয়ে দিগুন টাকা লাভ হয়েছে বলে জানান তিনি। সার ও বিষ মুক্ত হওয়ায় এর চাহিদা ব্যাপক। স্থানীয় সবজি বিক্রেতারা ভাসমান বেড থেকে এসব শাক-সবজি কিনে নিয়ে যায়। কৃষি গবেষণা থেকে ভাসমান বেডে চাষ পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষন নিয়েছেন কৃষক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন প্রথমে একটি বেডে টমেটো চাষ করে অনেক লাভবান হয়েছেন তিনি সেই আগ্রহে আরো চারটি বেডে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেছেন। সদর উপজেলার চংশোলাকিয়া গ্রামের কৃষক মো. ফয়েজ উদ্দিন বলেন, প্রথমে ভাসমান বেডে চাষের পদ্ধতি সর্ম্পকে ধারণা না থাকায় কৃষি গবেষণা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে তিনি অনেক লাভবান। কম খরচ ও লাভ বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে যে সময় ভাসমান বেডে বিভিন্ন সবজি ও মসলা চাষ করা হয় সে সময় জমিতে এসব ফসলের চাষ করা যায় না। অথচ ভাসমান বেডে চাষ করলে এর ব্যাপক উৎপাদন হয়। চাহিদাও বেশি থাকে বাজারে নেওয়ার পর বেশি দামে বিক্রি করা যায়।
কিশোরগঞ্জ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন বলেন, শুরুর দিকে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ করা যায় বিশ^াসও করত না এখনাকার স্থানীয় কৃষকরা। এখন এর চাহিদা বেশি থাকায় কেউ কেউ স্থানীয় কৃষকদের এই সাফল্য দেখে পুকুর, খাল, বিল ও নদীতে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে নিজেরাও ভাসমান বেডে চাষ পদ্ধতিতে আগ্রহ হয়ে উঠেছেন।
ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বলেন, কিশোরগঞ্জে গত তিন বছরে স্থানীয় কৃষকদের এই চাষে আগ্রহ করে তুলতে আগাছা ও কচুরিপানাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বিভিন্ন জাতের সবজি ও মসলা উৎপাদন করা যায় এসব বিষয়ে কৃষকদের বিভিন্ন সময় মাঠ দিবসের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করণ ও সরকারি পৃষ্টপোষকতা প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোঃ নাজিরুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জমির পরিমান দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই জমির ঘাটতি পূরণ করে খাদ্য জোগান দেওয়ার জন্য ভাসমান বেডে আবাদের মাধ্যমে মূলধারার কৃষির বাহিরে দেশের ১০ ভাগ খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে ভাসমান পদ্ধতিটা মূল লক্ষ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সারাদেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জায়গা জলাবদ্ধতা থাকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে এসব এলাকায় সারা বছর যেন ফসল উৎপাদন করতে পারে কৃষক এই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৭১টি উপজেলায় ইতিমধ্যে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা আবাদ করা হয়েছে। এর বিস্তার আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এই দেশ। এতে করে দেশের খাদ্য চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন কৃষক।