জৌলুস হারিয়েছে চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজ

0

রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া,বরিশালঃ

ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে অনগ্রসর বাঙালী জাতিকে অগ্রসর জাতিতে রুপান্তরিত করতে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী বাংলার বাঘ খ্যাত শের-ই বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৪০ সালে তাঁর এলাকা চাখারে ৩৫ একর সম্পত্তির ওপর নিজ নামে ফজলুল হক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে কলেজটি সরকারীকরণ করা হয়। ৮১ বছর ধরে চাখার সরকারী ফজলুল হক কলেজ বরিশাল অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।

এ কলেজ থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে প্রাশসন ও রাজনীতির শীর্ষ পদে আসীণ হয়ে দেশ বিদেশে সুখ্যাতি ছড়িয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী এ কলেজে সর্বশেষ ১৯৮০-৮১ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ের কলেজের জিএস,বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও চাখার ইউপি’র সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান খিজির সরদার জানান, এক সময় এ কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের ওপরে ছিলো। ওই সময় শিক্ষার্থীদের পদভারে শুধু কলেজ ক্যাম্পাস নয় গোটা চাখার ও পাশ^বর্তী এলাকাও মুখরিত ছিলো। দক্ষিনাঞ্চলের দূর দূরান্ত থেকে শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীরা তখন চাখার ও এর পাশের ইউনিয়নের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আবার অনেকে লজিং মাষ্টার হিসেবে থেকে লেখাপড়া করতো।

খিজির সরদার আরও জানান,আগে ৩ বছর পরপর ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো। নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিত। চাখার কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে পরিমল কুন্ডু সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৮৪ সালে কলেজে সর্বশেষ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এবং নির্বাচন প- হয়ে যায়। এ নির্বাচনের পর থেকে এ কলেজে আর কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। সেই সময়ের সরব ছাত্র সংসদ এখন কেবলই ধুসর স্মৃতি। বর্তমান শিক্ষার্থীরা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন। এদিকে কালের পরিক্রমায় বরিশালের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অসংখ্য কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর চাখার সরকারী ফজলুল হক কলেজ তার পুরনো জৌঁলুস হারিয়ে ফেলে। অথচ এক সময় বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এ বিদ্যাপীঠটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কলেজটি শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করে আসছিল। এ কলেজে স্বল্প খরচে মেধাবী ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা সুশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে কলেজে বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি,অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা মোট ৯টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর পরেও তার পুরনো সেই গৌরবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা।

কলেজে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজারে এসে নেমেছে। অন্তহীন সমস্যা ও সংকটে কলেজটি অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দুই দশক পূর্বে নির্মিত কলেজের তিন তলা ভবন দুটি নির্মাণ কাজ নিম্নমানের হওয়ায় এরই মধ্যে পলেস্তারা খসে পড়ে এবং দেয়াল ও ছাদে অসংখ্য ফাঁটল সৃষ্টি হয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি নামলেই ছাদ চুইয়ে পানি শ্রেণী কক্ষের ভিতরে পড়ে একাকার হয়ে যায়। ফলে পাঠদান ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এছাড়া ১৯৬৮ সালে নির্মিত বিজ্ঞান ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ায় প্রতিটি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করতে পারছেন না। দীর্ঘ ভোগান্তি শেষে বর্তমানে একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ৬ তলা বিশিষ্ট এ ভবনটিতে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে কলেজে ব্যবহারিক বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রসারতা লাভ করবে।

এদিকে অধ্যক্ষের বাসভবন ও ছাত্রাবাস জরাজীর্ণ ভুতুরে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের বসবাসের জন্য নেই ডরমেটরি । ফলে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের বরিশাল শহর কিংবা অন্যত্র বসবাস করতে হয়। আবাসিক কোয়ার্টার সংকটে যোগদানের পর অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষকরা অন্য কলেজে বদলি হয়ে যান। ফলে শিক্ষক সংকটে মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রকৃত পাঠগ্রহণ করতে না পেরে কাঙ্খিত ফলাফল করতে পারছেন না। শিক্ষক কোয়ার্টার না থাকায় শিক্ষক সংকটও কাটছে না। কোটা অনুযায়ী শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। কলেজে ছাত্র ও ছাত্রী নিবাস না থাকায় ভর্তির কোটা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা একাদশ, দ্বাদশ ও অনার্স বিষয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটে রয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী এ কলেজে অধ্যক্ষ, ১২ টি প্রভাষক, ৪টি সহকারী অধ্যাপক, ৭ টি সহযোগী অধ্যাপক, ৩টি প্রর্দশক এবং লাইব্রেরিয়ান ও সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এছাড়া ১৩টি চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর পদ শুণ্য রয়েছে। বিশেষ করে হিসাবরক্ষক ও হিসাব সহকারী পদ শুন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে প্রফেসর এ.এস.এম হাবিবুল ইসলাম দায়িত্ব পালণ করছেন। ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর পাঁচতলা বিশিষ্ট ২টি একাডেমিক ভবন, তিন তলা বিশিষ্ট দুটি ছাত্র ও ছাত্রী নিবাস নির্মাণ ও অধ্যক্ষ’র কোয়ার্টার সংস্কার এবং আসবাব পত্রের জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করা হয়। এর মধ্য থেকে শুধু একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে দেশ এগিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের এই সময়ে সরকারী এ কলেজে নেই কম্পিউটার ল্যাব। ১৯৪০ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় নির্মিত সুউচ্চ দ্বিতল ভবনটি এখনও ভাল থাকায় সেই সময়ের ঠিকাদার সহ সংশ্লিষ্টদের সততার বিষয়টি আজও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এদিকে ২০১৬ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদকে প্রধান অতিথি করে ঐতিহ্যবাহী এ কলেজের ‘হিরক জয়ন্তী’ উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু করেও অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. শাহে আলম বলেন, চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজে একটি নতুন ছয়তলা ভবন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাঙালী জাতির মহান নেতা শের-ই বাংলা একে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশনসহ হারানো হৃদগৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে।

কলেজের সাবেক ছাত্র ও বানারীপাড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল বলেন, বর্তমান সরকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছে। কিন্তু চাখার কলেজে আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি। কলেজে পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করা দরকার। সব বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করাসহ চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজকে তিনি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার দাবি জানান।

এ প্রসঙ্গে চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর এ.এস.এম হাবিবুল ইসলাম বলেন নানা সংকটের মধ্যেও কলেজের অতীত হৃদগৌরব ফিরিয়ে আনতে নানামুখি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে গোটা দক্ষিনাঞ্চলকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণে যে কলেজটি আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালণ করেছে সংকট ও সমস্যা দূর করে সেই কলেজটির আবারও হারানো হৃদগৌরবে ফিরিয়ে আনার দাবী জানিয়েছেন শিক্ষা সচেতন এলাকাবাসী।

Share.