ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোকাররম এখন হকার

0

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
আজ ৩ডিসেম্বর, ৩১তম আন্তর্জাতিক ও ২৪তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও তাদের কর্মকান্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে দিবসটির সূচনা। প্রতিবন্ধিতা কোন বাঁধা নয় বরং সুস্থসবল মানুষের মতো জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এমন দৃষ্টান্ত এ দেশে যেমন অগনিত তেমনি অবহেলার সংখ্যাও কম নয়। যাদের ইচ্ছা আর মেধা থাকার পরেও সহযোগিতার অভাবে ঝড়ে পড়তে হয় অল্পতেই। তেমনি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার ২নং সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সহশ্রাম গ্রামের রাজমিস্ত্রি রফিকুল ইসলামের তিন ছেলের মধ্যে বড় মোকাররম হোসেন (২৪)। জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোকররমের অদম্য শক্তি আর মেধার গুণে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাকে আকড়ে ধরে ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বপ্ন ছিলো অনেক বড়। জন্ম থেকেই যার ভাগ্যে সৃষ্টিকর্তা অসহায়ত্বের ছাপ দিয়ে দিয়েছেন তার কপালে কি আর সুখ হয়? আর্থিক অভাব অনটন আর করোনার কারণে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ঝড়ে পড়েন মোকাররম। বই পুস্তক গুছিয়ে পরিবারের হাল ধরতে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। বর্তমানে ট্রেনে হকারি করে বেড়ান তিনি।

সরেজমিনে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর একটি বেসরকারি ব্যাংকের বৃত্তির টাকায় দুই বছর পড়ালেখা চালিয়ে যান। তবে করোনা মহামারিতে বন্ধ হয়ে যায় বৃত্তির টাকা। সেইসঙ্গে লেখাপড়াও। মোকাররম ২০১৫ সালে পার্শ্ববর্তী নরসিংদী জেলার কারারচর মওলানা তোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সরকারি মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পসে করেন। শুধু মোকাররম নয়, তার সহোদর দুই ভাই আবু রোজিন (২১) ও মোহাম্মদ হাসান (২০) জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আবু রোজিন দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন ও মোহাম্মদ হাসানকে ১০ পাড়া কোরআনের হাফেজ বানিয়েছেন। অর্থের অভাবে আর তাদের পড়ালেখা হয়নি। তিন সন্তান, পুত্রবধূ, নাতি নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবারটি।

মোকাররম বলেন, কষ্ট করে হলেও সব কিছু ভালোভাবেই চলছিল। রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া ও অডিও করে পড়াশোনা করতে অনেক খরচ হয়। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে বৃত্তি হিসেবে যে টাকা পেতাম তাই দিয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা করতাম। অনেক সময় পরীক্ষার রাইটার পেতে কষ্ট হতো। সহপাঠীরা অডিও করে দিতো না। তাদেরকে খাওয়ালেই তারা পড়া অডিও করে দিতো। হঠাৎ করোনা মহামারি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় সেই ব্যাংকের বৃত্তির টাকা দেওয়া এরই সাথে বন্ধ হয়ে যায় আমার পড়ালেখা। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু হয়নি। প্রতিবারই প্রতিবন্ধিতা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বা বেসরকারি একটি চাকরি খুবই দরকার। কারণ পরিবারে এক সন্তান, স্ত্রী ও বাবা-মাসহ প্রতিবন্ধী ছোট দুই ভাই রয়েছে। সবার ভরণপোষণ বাবার একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এখন মাঝে-মধ্যে ট্রেনে হকারি করি। এভাবেই চলছে সংসার। তিন ভাই প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে যা সামান্য পাই তা দিয়ে সংসার চলে না।

মোকারমের মা হোসনা আক্তার বলেন, জন্ম থেকেই তিন ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। অভাবের সংসারে ছোট দুই ছেলেকে বেশি লেখাপড়া করাতে পারিনি। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ও মেধাবী ছিল তাই বৃত্তি পেত। হঠাৎ করোনার কারণে সব শেষ হয়ে গেল। এখন তো আমরা জীবিত আছি, তাই ওদের জন্য কিছু করতে পারছি। আমরা যখন থাকব না, তখন তাদের কী হবে?

২নং সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাসেম আকন্দ বলেন, মোকাররমরা তিন ভাই প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে সহায়তা করতে চেষ্টা করব। এছাড়া মোকারমের যোগ্যতা অনুযায়ী যেন চাকরি পায় সেই জন্য চেষ্টা করব।

কিশোরগঞ্জ সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামরুজ্জামান খান বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই তিন ভাই ভাতা পাচ্ছেন। এখন তাদের পরিবার যদি সমাজসেবা থেকে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চাইলে ব্যবস্থা করা যাবে।

Share.