স্টাফ রিপোর্টারঃ
বাউত উৎসব গ্রাম বাংলার একটি আদি ঐতিহ্য। ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা উৎসব অথবা পলো বাওয়া এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। কালের সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কিশোরগঞ্জে পালিত হলো বাউত উৎসব। বুধবার (২৫ অক্টোবর) ফজরের আজানের পরপরই দূর দূরান্ত থেকে মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে আসতে শুরু করেন মাছ শিকারিরা। উদ্দেশ্য শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নের রৌহা বিলে বাউত উৎসব স্থানীয় ভাষায় (হাইত বাওয়া)। যেখানে প্রতি বছর হাজারের ও অধিক মাছ শিকারিরা অংশ গ্রহণ করেন।
সকাল ৬টায় উৎসবে যোগ দিতে রাত থেকে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নান্দাইল, গাজীপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া ছাড়াও বিভিন্ন জায়গাতে ছুটে আসেন ছেলে বুড়ো সকলেই। নিজ নিজ পলো, হাতজাল, উড়ালজাল, ও লাঠিজালসহ নানা ধরনের মাছ ধরার জিনিসপত্র নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। যেমন, রুই, কাতল, মৃগেল, শোল, বোয়াল ইত্যাদি। তবে এ বছর সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে মাছ শিকারিদের। বিলে যেমন মাছ সংকট সেই সাথে কুচুরিপানার জন্য পলো আর জাল নিয়ে কোনভাবেই সুবিধা করতে পারেনি মাছ শিকারিরা। ফলে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। ভোর ছয়টায় শুরু হওয়া উৎসব চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। তবে এবার মাছ না পাওয়ায় শুরু হওয়ার ঘন্টাখানের মধ্যে বাড়ি ফিরে যায় মাছ শিকারিরা।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়নের মাছ শিকারি আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, বিলের মধ্যে ধামে ভর্তি ( কুচুরিপানা) এই জন্য পানির নিচ পর্যন্ত পলো চাপানো যায় না। তাছাড়া পায়া (নিচে) মাছ নাই। বন্যার পানির সাথে সাথে মাছ চলে গিয়েছে।
কটিয়াদীর হুমায়ুন কবির বলেন, আমি ভোর সাড়ে চারটায় আসছি। কোনভাবেই হাইত (বাউত) বাইতে পারছিনা। পানি কিছুটা কম থাকলেও কুচুরিপানা খুব বেশি। পানিও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক ঘন্টায় এক মাছ ধরতে পারি নাই।
মোঃ সুমন মিয়া বলেন ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে আসছি। প্রতিবছর এই বিলে মাছ ধরতে আসি কিন্তু এই বছর মাছ ধরার কোন আশঙ্কা নাই। বন্যার পানি হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোন মাছ নাই। গতবছর প্রচুর পরিমানে মাছ ধরা পড়েছিল
৬০ বছর বয়সি আতাউর রহমান বলেন, আমি গত ৩০ বছর যাবত এই বিলে মাছ শিকারে আসি। প্রচুর মাছ ধরা পড়ে কিন্তু এই বছর একটাও পাইনি। প্রায় ৫ কিলোমিটার লম্বা এই বিল থেকে খালি হাতে বাড়ি যাচ্ছ্।ি সাইদুল ইসলাম নামে এক মাছ শিকারি বলেন, আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে এখানে এসে সকলের অবস্থা দেখার পর আর পানিতে শরীর ভেজায়নি। এভাবে বাড়ি চলে যাচ্ছি। ১৮ বছর বয়সি রাকিব মিয়া বলেন, আজকে এখানে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে গতকাল মঙ্গলবার ৫০০ টাকা দিয়ে জাল কিনে আসছিলাম। এখন মনে হচ্ছে টাকাটা শুধু শুধু খরচ করেছি। মোঃ শামিম বলেন, রাত দুইটার সময় ২০০ টাকা খরচ করে ভাড়া দিয়ে মাছ শিকারে আসছিলাম এখন খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। মোঃ রুবেল মিয়া বলেন, এলাকার মানুষ আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। এলাকায় মাইকিং করে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে এখানে এসে সকলেই হতাশ।
চৌদ্দশত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আতাহার আলী বলেন, শত বছরের ঐতিহ্য আমাদের এই রৌহা বিল। এখানে প্রতিবছর উৎসবমুখর পরিবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাছ শিকারিরা মাছ ধরে থাকেন। বিলের পাশে বাসা বাড়িতে দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা আগের দিন থেকে অবস্থান নেই। পরেরদিন তারাও আনন্দ নিয়ে মাছ ধরা উপভোগ করে। এ বছর প্রচন্ড বৃষ্টি ও বন্যার কারনে সকল ফিসারির মাছ বের হয়ে যায়। এতে করে এলাকার সাধারণ মানুষ রিং জাল, কারেন্ট জাল যে যেভাবে সম্ভব মাছ ধরে ফেলে এতে করে মাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে। এসব জালের কারণে ছোট-বড় সকল প্রজাতির মাছ ধরা পড়ছে আর এ কারণে মাছের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ দেশে মাছ নিধন রোধে যে ধরনের আইন আছে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আর কারণেও যে যেভাবে পারে পোনা মাছসহ সকল মাছ ধরে ফেলে। সরকারের যে নির্দেশনা প্রতিবছর দেওয়া হয় দুই থেকে তিনমাস মাছ ধরা থেকে বিরত রাখতে সে নির্দেশনা যদি এখানেও এই বিলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে প্রতি বছর বাউত উৎসবে প্রচুর মাছ ধরা পড়বে