হোসেনপুরে টিফিনের টাকায় পাঠাগার স্থাপন

0

 খায়রুল ইসলাম ( কিশোরগঞ্জ) হোসেনপুরঃ

যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীদের একতার শক্তি দিয়ে সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক  কর্মকাণ্ডে  অংশগ্রহণে আমূল পরিবর্তনের ইতিহাস রয়েছে। ওদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি  দুঃসাধ্য কাজকেও হার মানাতে বাধ্য করে।তেমনি একদল দূরন্ত স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া কিশোর তাদের টিফিনের টাকা জমিয়ে গড়ে তুলেছে ” শিশুদের হাসি পাঠাগার” নামে একটি  লাইব্রেরি ৷

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের প্রতিদিনের টিফিনের টাকা হতে কিছু টাকা জমিয়ে গড়ে তুলেছে একটি দৃষ্টিনন্দন লাইব্রেরি ।যা ছিল অসাধ্য ও কল্পনাতীত।

শুরুটা ২০১৮ সালে। স্কুল ও কলেজের অনেক শিক্ষার্থীদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ থাকলেও তাদের উপজেলায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি ছিল না। ফলে তাদের বই পড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছা থাকলেও তারা বই পড়ার সুযোগ হতো না ৷ তাদের মধ্যে একটা পাবলিক লাইব্রেরির শূন্যতা কাজ করছিল৷ এমন সময় নবম শ্রেণি পড়ুয়া মাহমুদুল হক রিয়াদ,আল জাবির ইয়াসিন, মাহফুজুল হক ফাহাদ ও জুনায়েদ রাব্বি প্রকাশ তাদের মনে হলো একটা পাবলিক লাইব্রেরি থাকলে পাঠ্য বই ছাড়াও তারা অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারবে৷

সে ভাবনা থেকেই তারা হোসেনপুরে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করার কাজ শুরু করে দেয়৷ তারা কথা বলে তাদের সহপাঠীদের সাথে। সবাই তাদেরকে উৎসাহিত করে। এইভাবে তারা পাঠাগারের জন্য সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে।  কিছুদিনের মধ্যে ১০০ সদস্য সংগ্রহ করে ফেলে । সবাই একত্রে সিদ্ধান্ত নেয় ,তারা তাদের টিফিনের টাকা হতে প্রতিদিন ১ টাকা হারে মাসে ৩০ টাকা চাঁদা দিবে। কয়েকমাস টাকা জমিয়ে লাইব্রেরির জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও বই কিনবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়।

সে সময় রিয়াদ তাদের এই উদ্যোগের কথা জানান কবি ফখরুল হাসানের কাছে। তিনি তার এলাকার শিক্ষার্থীদের এমন আগ্রহ দেখে নিজে ১০০ বই দেন এবং তাদের কে পাঠাগার স্থাপনের কাজে নানাভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন ।

কয়েক মাস টাকা জমানোর পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দর জীবনের জন্য বই স্লোগান নিয়ে জুনায়েদ রাব্বি প্রকাশের বাসায় শুরু হয় তাদের লাইব্রেরির যাত্রা। তাদের জমানো টাকা হতে একটি বুক সেলফ, ২ টি টেবিল, কিছু চেয়ার ও প্রায় ৩০০ বই নিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু করে দেয় শিক্ষার্থীরা। তারা তাদের সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পাঠাগারে বই পড়া ও সর্বোচ্চ ৭ দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে বই পড়ার পদ্ধতি চালু করে ৷

তাদের এই কার্যক্রম ফেসবুকের মাধ্যমে নজরে আসে কিশোরগঞ্জ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক আজিজুল হক সুমন সাহেবের। তিনি পাঠাগার সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কয়েক দফা কথা বলেন এবং পাঠাগারটি পরিদর্শন করে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা দেন। এর পর থেকে তাদের আর পিছনে তাকাতে হয়নি, একে একে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে  সদস্য সংখ্যা ২০০। তাদের এই মহৎ কাজে যুক্ত হতে থাকে শিক্ষক ও এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।

২০২০ সালে করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও তারা হটলাইন নাম্বারের মাধ্যমে সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পোঁছে দিয়ে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। তাদের কার্যক্রমকে ডিজিটাল করার জন্য তারা ইতিমধ্যে গুগল প্লে স্টোরে একটি এ্যাপস তৈরি করেছে যেখানে তাদের সকল বইয়ের তালিকা ও বইয়ের জন্য আবেদন করা যায় ৷ এছাড়াও নতুন প্রজন্মের মেধাবিকাশের জন্যে পাঠাগারের সদস্যরা জাতীয় দিবসগুলোতে রচনা,চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলছে৷ তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সামাজিক ও মানবিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বর্তমানে পাঠাগারটি হোসেনপুর প্রশিকা অফিসের একটি বড় রুমে অবস্থিত। পাঠাগারটির বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ১ টি বুক সেলফ থেকে এখন ৩ টি বুক সেলফ। গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সাইন্স ফিকশন, শিশুতোষ ও দেশ-বিদেশের অনেক বইয়ের সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে শিশুদের হাসি পাঠাগার৷

প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক রিয়াদ জানান, আমাদের উপজেলায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি নাই,স্কুলের লাইব্রেরি সবসময় তালাবদ্ধ। পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের জ্ঞানঅর্জন। অজানা কে জানার আগ্রহ থেকেই আমরা সবাই মিলে পাঠাগার স্থাপন করেছি৷

পাঠাগারের অন্য এক সদস্য শাহরাজ হোসেন রিয়াদ বলেন, অবসর সময়ে  মোবাইল ও ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম । পাঠাগার স্থাপনের পর আমার অবসরের সময়টা তে সাইন্স ফিকশন বইয়ের সাথে কাটে।

পাঠাগারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুল হক ফাহাদ বলেন, আমরা এখনো বই সংগ্রহ করছি, করোনার কারনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। করোনার সময়ে আমরা হটলাইন নাম্বার চালু করি যার মাধ্যমে সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসছি। এখন পর্যন্ত যারা আমাদের সদস্য তারাই শুধু পাঠাগারে বই পড়তে পারছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বই ও অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে আমাদের পাঠাগারটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিব৷ তারা পাঠাগারটি কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছে। তারা পাঠাগারটিকে স্থায়ী করার জন্য নিজস্ব জমি ও ভবনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।

Share.