কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা মিঠামইনে নবনির্মিত দেশের ৩২তম ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস’র উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টা ২২ মিনিটে মিঠামইন সদরের ঘোড়াউত্রা নদীর তীরে নবনির্মিত সেনানিবাসের উদ্বোধন করেন। এর আগে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে মিঠামইন সেনানিবাসের হেলিপ্যাডে পৌঁছান। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় অভিবাদন গ্রহণ করেন।
জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তাসহ হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ৩৫০ কোটি ৩৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ২৭৫ একর জায়গায় আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো হাওরের বুকে নবনির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাসের। কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের পর সেনানিবাসে ৪টি ইউনিট এবং এসএসডি জাজিরা এর পতাকা উত্তোলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ইউনিটগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সশস্ত্রবাহিনী গড়ে উঠেছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সার্বভৌম রক্ষার জন্য একটি সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলা এবং একটি সশস্ত্রবাহিনী গড়ে উঠবে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। ১৯৭৪ সালে তিনি একটি নীতিমালা করে দিয়ে গিয়েছেন। এবং তারই ভিত্তিতে ফোর্সেস গোল্ড ২০৩০ প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর পূনঃবিন্যাস করা হয়েছে। বিগত চার বছরে বিভিন্ন ফরম্যাশনের অধিনে তিনটি ব্রিগ্রেড এবং ছোট বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমান সরকার সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছে। হাওর এলাকার সার্বিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেনানিবাস।
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সর্ম্পকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ সবসময় জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ এই অঞ্চল থেকে বার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই দুর্গম এলাকার মানুষের সাথে থাকা, তাদের খোঁজ খবর রাখা, তাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার ইচ্ছা ছিল এই অঞ্চলে সেনানিবাস গড়ে তোলা। তিনি মনে করেন সেনানিবাস হলে এই অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। তার ইচ্ছা পূরণেই এখানে সেনানিবাস গড়ে তুলা হয়েছে। মোঃ আবদুল হামিদ প্রতি ক্ষেত্রে যখন যে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে থেকেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পরর্বতী যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়তে তার বিরাট অবদান রয়েছে। তিনি নিবেদিত প্রাণ এবং সৎভাবে জীবনযাপন করে গিয়েছেন। তার নামে সেনানিবাস করতে পেরে আনন্দ মনে হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হয়েছে আর তাই সেনানিবাসে স্কুল, কলেজ, চিকিৎসাকেন্দ্র হবে। মানসম্পন্ন পাঠদানের সুবিধা সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাওর, বিল ও জলাভূমি অঞ্চলে প্রতিটা রাস্তাঘাট হবে এলিভেটেড। যেন বর্ষাকালে পানি ও নৌকা চলাচল অব্যাহত থাকে। এবং সেনানিবাস থেকে ঢাকা সিলেট যোগাযোগ অবস্থা ঠিক থাকবে
গত ১৪ বছরের উন্নয়ন নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক সংগ্রামের পদ বেয়ে আজ আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা পেয়েছি। গনতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখার ফলে বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে যে উন্নয়ন করেছে তা গত ২৯ বছরেও সম্ভব হয়নি। আমরা চাই বাংলাদেশ আরো উন্নত হবে। আমি আমার পরিবারের সকলকে হারিয়েছি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ আত্মসামাজিক ভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই আমরা পথ চলছি। এ দেশে একটি মানুষও ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না, ক্ষুদার্থ থাকবে না। তাদের সুখে রাখতে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা সমাধান করে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করা হয়েছে। অবৈধভাবে যারা ক্ষমতায় গিয়েছিল তারা এর সমাধান করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সীমানাচুক্তি বাস্তবায়ন, চিটমহল বিনিময় করে বিশে^র কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যে শান্তিপূর্ণভাবেও প্রতিবেশী দেশের সাথে চিটমহল বিনিময় করা যায়।
অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে সরকার প্রধান বলেন, করোনা মহামারির পর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে সকল পণ্যের মূল্য ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। আজকে উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের দেশে আমরা এখনও অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল রাখতে পেরেছি। বাংলাদেশে যেন এমন না হয় তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাধি না থাকে তার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। সকল অনাবাধি জমি চাষের আওতায় আনা হবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, তেল সকল কিছুতেই মিথব্যয়ী হওয়ার প্রতি আহ্বান জানান সরকার প্রধান। ইতোমধ্যে রুপকল্প বাস্তবায়ন করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ^ দরবারে মাথা উচু করে চলবে। কারো কাছে হাত পেতে নয় নিজের উন্নতি নিজে করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। শেষে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর ও সেনানিবাস ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য রিভারাইন বা নদী তীরস্থ রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের হোম স্টেশন এই সেনানিবাস। এখান থেকেই হাওর এবং নদী এলাকা অপারেট করবে সেনাবাহিনী। ২৭৫ একরের ওপর নির্মিত এই সেনানিবাসকে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। বিশ্বমানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে এই সেনানিবাসকে। যেখানে আছে সর্বাধুনিক মিলিটারি স্পিডবোট। যেগুলোর ৯০ ভাগই দেশে নির্মিত। এই সেনানিবাসের আওতায় থাকবে একটি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল রিসেল, যা থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একসঙ্গে ৫ হাজার সেনা অবস্থান করতে পারবে এই সেনানিবাসে। সব বিবেচনায় মিঠামইন রিভারাইন সেনানিবাস বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট।