কিশোরগঞ্জে কালজয়ী বইয়ের মোড়কে সাজানো দৃষ্টিনন্দন বই-দেওয়াল

0

স্টাফ রিপোর্টারঃ

মাদক, মোবাইল গেইমস, ফেসবুক এবং ইউটিউবে ডুবে থাকায় বর্তমান প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে কালজয়ী ৩৩টি বইয়ের মোড়কে বাড়ির দেয়াল সাজিয়ে রেখেছেন বই প্রমি মো. রাকিব হাসান। প্রতিদিনই এই বই-দেওয়াল দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। ভাষার মাসে আরও বেশি ভীড় করছে মানুষ। এই বই-দেওয়ালের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছে কালজয়ী বইয়ের নাম ও লেখকের নাম। এখানে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার হলে তরুণ প্রজন্ম কালজয়ী এসব বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে এমনটিই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

জানা যায়, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেরখাঁ ভাণ্ডা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন বই প্রেমিক। বাবা-মার মতো বই পড়ার অভ্যাস তাদের ছেলে মো. রাকিব হাসানেরও। তাই তিনি নিজে বই পড়ার পাশাপাশি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে এবং  মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি-প্রেক্ষাপটসহ বাঙালি জীবন ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এক অনুকরণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

রাকিব হাসান স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ৩৩টি বইয়ের নাম ও মোড়কে সাজিয়েছেন বাড়ির সামনের দেওয়াল। তার এই নান্দনিক আয়োজন ইতোমধ্যেই সারা জেলায় সারা জাগিয়েছে। সারা বছরই দেখতে আসে বিভিন্ন বয়সী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তবে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতে একটু বেশিই ভিড় জমে ওঠে এ বই-দেওয়াল বাড়ির সামনে। বই-দেওয়াল তৈরি করতে ঢাকা থেকে কারিগরি আনা হয়েছে। যাতে সময় লেগেছে ২ বছর।

এ বই-দেওয়াল রয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এর অগ্নিবীণা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গীতাঞ্জলি, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, জসীম উদদীন এর নকশী কাঁথার মাঠ, আনিসুল হক এর মা, হিসাম আল আওয়াদি এর বি স্মার্ট ইউথ মুহাম্মদ, স্যার সৈয়দ আমীর আলী এর দ্যা স্পিরিট অব ইসলাম, ইসলামি ফাউন্ডেশনের সীরাত ইবনে হিসাম, সমরেশ মজুমদার এর গর্ভধারিণী, সুকুমার রায় এর আবোল তাবোল, হুমায়ুন এর জোসনা ও জননীর গল্প, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর লালসালু, আরিফ আজাদ এর প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ, খালেদ হোসেইনি এর দ্যা কাইট রানার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পথের পাঁচালী, জীবনানন্দ দাস এর বনলতা সেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর আমার বন্ধু রাশেদ, আলেক্সান্দর বেলায়েভ এর উভচর মানুষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর চিলেকোঠার সেপাই, জাহানারা ইমাম এর একাত্তরের দিনগুলি, হারুকি মুরাকামি এর নরওয়েজিয়ান উড, শহীদুল্লাহ কায়সার এর সংশপ্তক, রশীদ হায়দার এর ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর মেঘনাদবধ কাব্য, আবু ইসহাক এর সূর্য দীঘল বাড়ি, আল্লামা ইবনে কাসির (রহ:) এর তফসিল ইবনে কাসির, জহির রায়হান এর বরফগলা নদী, আইজাক আসিমভ এর ফাউন্ডেশন, হুমায়ুন আহমেদ এর তোমাদের জন রুপকথা ও হেলাল হাফিজ এর যে জলে আগুন জ্বলে।

স্থানীয় স্কুলের শিক্ষার্থী শাহিনা আক্তার জানান, প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়ার সময়ই এই বাড়ির দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। দেয়ালের বইগুলো মাধ্যমে  বিভিন্ন বইয়ের নাম ও লেখকের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে। এই বাড়ির দেয়ালের বইগুলো দেখে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষ ছুটে আসছেন।

স্থানীয় এলাকাবাসী আশরাফুল ইসলাম জানান, কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেলপথের সাথে অবস্থিত আনন্দধারা নামের ছবির মতো এই বইদেয়াল বাড়িটি এখন আসা-যাওয়ার পথে ট্রেন যাত্রীদেরও দৃষ্টি কাড়ে। এই বইদেয়াল বাড়িটি এখন আমাদের এলাকার সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার স্থাপনের দাবি জানাই। উন্মুক্ত গ্রন্থাগার স্থাপিত হলে আমাদের এলাকার মানুষ বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

বইদেয়াল বাড়ির নির্মাতা ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থার উপমহাব্যবস্থাপক মো. রাকিব হাসানের জানান, আমরা কেউ মহান ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু এসব ইতিহাস পড়ার কারণে আমাদের চোখের সামনে মহান ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি মূর্ত হয়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস তার। মাদক, মোবাইল গেইমস ও সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক ধরনের বই বিমুখতা দেখা দিয়েছে। তাদের ভাবনাতেই যেন নেই মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এবং বাঙালি জীবন ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কালজয়ী সব বইয়ের নাম। অথচ একজন মানুষের প্রকৃত বন্ধু হচ্ছে বই। একজন বন্ধু যে কোনো বন্ধুকে কষ্ট দিতে পারে, কিন্তু বই কষ্ট দেয়না বরং বাতিঘর হয়ে পথ দেখায়। তাই নতুন প্রজন্মকে এসব বই পড়ার এবং বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস জানার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার চেষ্টায় তিনি বইদেয়াল বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই বাড়ি পরিদর্শন করে বই পড়ার চেতনা ফিরে এলে তার প্রয়াস সার্থক ও সফল হবে।

তিনি আরও বলেন, বই-দেওয়াল তৈরি করতে ঢাকা থেকে কারিগরি আনা হয়েছিল। যাতে সময় লেগেছে ২ বছর। এছাড়াও পরিকল্পনা করা সবমিলিয়ে ৪ বছর সময় লেগেছে। বাড়িতে কালজয়ী বইয়ের একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার গড়ে তোলারও কাজও শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন বই প্রেমিক বই-দেওয়াল বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রাকিব হাসান।

Share.